1. [email protected] : Admin : sk Sirajul Islam siraj siraj
  2. [email protected] : admi2017 :
  3. [email protected] : Sk Sirajul Islam Siraj : Sk Sirajul Islam Siraj
ব্রেকিং নিউজ :
বিনোদন :: গান গাইতে গাইতে মঞ্চেই গায়কের মর্মান্তিক মৃত্যু!,  খেলার খবর : অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপ চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ, বিমানবন্দরে যুবাদের জানানো হবে উষ্ণ অভ্যর্থনা,

কর্মবীর মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী – শফিক আহমদ শফি

  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ২৬ জুলাই, ২০২২
  • ১৮২ বার পঠিত

বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্তি মহাপরিচালক (আর এস) মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী পেশাগত কাজে দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে এক ভিন্নধর্মী ইমেজ গড়ে তুলেছেন। ইতিমধ্যে তিনি সংস্কৃতিঙ্গানে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বহু পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার তিনি। গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন পেশাগত ক্ষেত্রেও। সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী কাজের জন্য কর্মক্ষেত্রেও তিনি সমান সমাদৃত।
‘আমার দিকে তাকিয়ে দেখো তো আমাকে যায় কি চেনা, একাত্তরে যুদ্ধ করেছি/ আমি যে মুক্তিসেনা’, ‘জোছনার জলে গা ভিজিয়েছি/ খুলেছি এলোকেশ/ রুপালি চাঁদের সাথে মিতালি হয়েছে বেশ’, ‘তুমি ইতিহাসজুড়ে সর্বশ্রেষ্ঠ মহানায়ক এই বাংলার’—এরকম বহু গানের গীতিকার তিনি।
তার প্রায় সকল গানেই ফুঠে উঠেছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেমের কথা। অনেকটা সাদামাটাভাবেই শৈশব-কৈশোর পার হয়ে নব্বইয়ের দশকে তারুণ্যে পৌঁছে লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন তিনি। এরপর আর থেমে থাকেননি ।
আলাপকালে তিনি বলেন, আগে এমন তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার ছিল না। আমাদের সময়ে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের অবসর কাটত বই পড়ে, সেটা কবিতা হোক বা উপন্যাস। আমিও প্রচুর বই পড়তাম। তবে লেখালেখির অভ্যাস ছিল না। ওই সময়ে পড়া উপন্যাসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় ছিল বিমল মিত্রের উপন্যাস ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’। ওই উপন্যাসে একজন রেলওয়েকর্মী দীপংকর নামের চরিত্রটি আমাকে সাংঘাতিক নাড়া দেয়। বলতে পারেন, ওই চরিত্রটি আমাকে মানবিক ও সৎ হতে শেখায়।
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে প্রথম কবিতা লিখেন মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী। কবিতার নাম ‘মুক্তিযোদ্ধা’। এরপর আরও কিছু কবিতা লিখেছেন তিনি। তবে রেলওয়ের এই প্রকৌশলী নিজেই জানাচ্ছেন, লেখালেখির জগতে তার মূল যাত্রার শুরুটা ২০০৭ সালে। ওই সময় রাজশাহী রেলওয়েতে অতিরিক্ত প্রধান যন্ত্রপ্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন তিনি। কাজের ব্যস্ততা কম থাকায় অফিসের বাইরে বেশিরভাগ সময় কাটাতেন পদ্মার তীরে। সেই পদ্মা নদীর বিচিত্র রূপই তার লেখালেখির অনুপ্রেরণা হয়ে ধরা দেয়।
মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী আরও বলেন, তখনকার শুকনো পদ্মা আমার চোখের সামনে সবসময় যেন ধরা দিত উত্তাল হয়ে। ওই পদ্মা আমার লেখালেখিতে আরও বেশি আগ্রহের জন্ম দেয়। ওই সময় রেলওয়েতে সহকর্মী শাজাহান নামের একজন নিয়মিত গান গাইতেন রাজশাহী বেতারে। আমি তাকে একদিন বলেছিলাম কবিতায় সুর করতে পারবেন কি না। তিনি আমার লেখা ‘মুক্তিযোদ্ধা’ কবিতাটিতে সুর করে দিলেন। নিজের লেখা কবিতা সুরে বসে গান হিসেবে মঞ্চে গাওয়া হচ্ছে— সে ছিল এক দারুণ অনুভূতি। ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
ওই অনুপ্রেরণা আর থামতে দেয়নি মঞ্জুর-উল-আলমকে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিয়মিত লিখেছেন কবিতা, গান। দেশপ্রেম-মুক্তিযুদ্ধের মতো বিষয়ে লেখা তার কবিতা-গানগুলো পড়েছেন-শুনেছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারাও। তারা ভীষণ আপ্লæত হয়ে পড়তেন। এভাবেই একে একে তার লেখা গানের সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় শ’য়ের কোটা।
মঞ্জুর-উল-আলমের লেখা গানে সুর দিয়েছেন দেশের প্রখ্যাত সুরকাররা। দেশবরেণ্য শিল্পীরা কণ্ঠে তুলেছেন তার লেখা অনেক গান। আব্দুল জব্বার, সৈয়দ আব্দুল হাদী, রফিকুল আলম, ফাহমিদা নবী, শাম্মী আক্তার, শাকিলা জাফর, ফকির আলমগীর তো বটেই, পশ্চিমবাংলার জোজো, অমিত গাঙ্গুলিও তার লেখা গান গেয়েছেন। দুইটি অ্যালবামও বেরিয়েছে।
বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের একজন তালিকাভুক্ত গীতিকার হওয়ায় মঞ্জুর-উল-আলমের লেখা গান নিয়মিতই প্রচার হয় রাষ্ট্রায়ত্ত এই দুই প্রতিষ্ঠানে। বেতার আয়োজিত সবশেষ ইদ নকশা অনুষ্ঠানে যে পাঁচটি গান প্রচার করা হয়, তার সবগুলোই তার লেখা। এতসব গানের মধ্যেও বিশেষ করে তার দেশ ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা গানগুলো বেশি প্রশংসিত বিভিন্ন মহলে। তার ‘মুক্তিযোদ্ধা’ গানটি গেয়েছেন প্রয়াত আব্দুল জব্বার। সেই গান নিয়ে বিশেষ স্মৃতিও আছে।
একবার স্বাধীনতা দিবসে গানটি বঙ্গভবনে লাইভ অনুষ্ঠানে গেয়েছিলেন আব্দুল জব্বার। তখনো আব্দুল জব্বার চিনতেন না এই গানের গীতিকার মঞ্জুর-উল-আলমকে। গানটি গাওয়ার পর সংগীত পরিচালকের কাছ থেকে নম্বর নিয়ে ফোন করেছিলেন তাকে। বলেন, “আমার গাওয়া হাজার গানের মধ্যে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ গানটি অন্যতম।” মঞ্জুর-উল-আলম বলেন, তার মতো একজন কিংবদন্তী শিল্পীর কাছ থেকে এমন মন্তব্য পাওয়া ভীষণ গর্বের বিষয়। তার সেই কথাটি এখনো আমাকে নাড়া দেয়।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ মুজিববর্ষ উপলক্ষে ‘মহানায়ক’ শিরোনামেও একটি গান লেখেন রেলওয়ের এই প্রকৌশলী। রাজেশ ঘোষের সুরে গানটিতে কণ্ঠ দেন ওয়ারফেজ ব্যান্ডের সাবেক ভোকালিস্ট মিজান। মেলো ও রক ধাঁচের গানটি গত বছর ডিসেম্বরে ইউটিউবসহ ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্তি পায় জি-সিরিজের ব্যানারে। জাতির পিতার জীবনকে অত্যন্ত আবেগ দিয়ে তুলে আনা এই গানটি জনপ্রিয়তা পায় শ্রোতা ও সমালোচকদের কাছে। এই গানের জন্য শমরেস বসু সাহিত্য পুরস্কার, রফিকুল হক দাদুভাই স্মৃতিপদকসহ বেশকিছু পুরস্কারে ভূষিত হন।
জাতির জনকের ঋণ তো কারও পক্ষে শোধ করা সম্ভব না। কিন্তু তার প্রতি যে অপরিসীম শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা এবং ভালোবাসা রয়েছে, সেটিই আমি এই গানটিতে প্রকাশ করতে চেয়েছি। সেটি হয়তো পেরেছি বলেই গানটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এ এক অন্যরকম ভালোলাগার বিষয় আমার জন্য,’— মহানায়ক গানটি নিয়ে এভাবেই নিজের অনুভূতি জানালেন মঞ্জুর।
ভালোলাগা, ভালোবাসা থেকেই শিল্প-সংস্কৃতি চর্চায় যুক্ত মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী। তবে এগুলো তার অবসর জীবনেও সহায় হয়ে উঠবে বলেই মনে করেন। তিনি বলেন, যখন অবসরে যাব, তখন এসব নিয়ে পুরোপুরি জড়িয়ে থাকতে পারব। এর বাইরেও লেখালেখি করি। নিয়মিত কলাম লিখি। অর্থনীতি, প্রাগৈতিহাসিক, সামাজ-সংস্কৃতির মতো বিষয়গুলো নিয়ে আগ্রহ রয়েছে। কর্মজীবন শেষ করে যখন অবসরে যাব, এগুলোর সঙ্গে যুক্ত থাকায় তখন নিশ্চয় কাজের অভাব বুঝতে পারব না।
সাহিত্য-সংস্কৃতির বাইরেও একজন সৎ, দক্ষ ও মেধাবী কর্মকর্তা হিসেবে মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী সুপরিচিত। ১০ম বিসিএসে রেলওয়ের দুইটি ক্যাডারে কর্মরতদের মধ্যে পিএসসির মেধাতালিকায় প্রথম ছিলেন তিনি। তার পরিকল্পনাতেই প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ভ্রাম্যমাণ রেল জাদুঘর’, যা গত ২৭ মে উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশ রেলওয়েতে যেসব উদ্ভাবনী কাজ হয়েছে তার পুরোটাই এসেছে মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরীর চিন্তা ও পরিকল্পনা থেকে।
তার পরিকল্পনায় প্রতিষ্ঠা কর হয় এই জাদুঘর নির্মাণের মূল ভাবনা, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন বলতে গেলে একক প্রচেষ্টায় করেছেন মঞ্জুর-উল-আলম। রেলমন্ত্রীর পৃষ্ঠপোষকতায় এই অভিনব উদ্ভাবনী কাজটির প্রশংসা করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মঞ্জুর জানালেন, শিগগিরই জাদুঘর দুইটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ রেল স্টেশনসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্টেশনগুলোতে বঙ্গবন্ধুর জীবন ইতিহাসকে পৌঁছে দেবে সাধারণ মানুষের মাঝে।
বর্তমানে রেলওয়ে তাদের সেবা বহুমুখী করার উদ্যোগ নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে স¤প্রতি স্কয়ার হাসপাতালের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে নির্মাণ করতে যাচ্ছে ইমারজেন্সি হসপিটাল কাম অ্যাম্বুলেন্স। এই কাজের মূল দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী। তিনি বলেন, এরই মধ্যে পাহাড়তলি কারখানায় একটি এয়ারব্রেক সম্বলিত কোচ নির্ধারণ করে মোডিফিকেশন কার্যক্রম চলছে। শিগগিরই এই রেল অ্যাম্বুলেন্সও সেবা দিতে শুরু করবে।
সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় স্মৃতি সৌধ নির্মাণ মঞ্জুর উল-আলম চৌধুরীর আরেকটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ।
সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীদের নিয়ে ২০১৩ সালে রেলের অকেজো যন্ত্রাংশ ও মালামাল দিয়ে নির্মাণ করা হয় ‘অদম্য স্বাধীনতা’ নামের এই স্মৃতিসৌধ। সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাশ্রম ও নিজেদের অর্থ দিয়েই স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করা হয়।
তিনি বলেন, এই কাজটি অনেক কঠিন ছিল। কারণ যুদ্ধ চলাকালীন এখানে যা ঘটেছিল, সেই ইতিহাস প্রায় বিলীন হতে বসেছিল। সৈয়দপুর রেল কারখানায় একাত্তরে কাজ করা সেসব শ্রমিকদের উত্তরাধিকারীদের খুঁজে বের করতে হয়েছে। ওখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যারা জীবিত, তাদের সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে। সবার সহযোগিতা নিয়ে প্রকৃত ইতিহাস তুলে আনার চেষ্টা করেছি। স্মৃতিসৌধে সে ইতিহাস খোদাই করে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, যেন ভবিষ্যতে কেউ ইতিহাস বিকৃত না করতে পারে।রেলওয়ের নানা উদ্যোগের মধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ে তার সক্ষমতা বাড়াতে নিজস্ব পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। রেলমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগে মূল দায়িত্ব পালন করছেন মঞ্জুর-উল-আলম। তিনি জানান, ভারতীয় রেলের রাইটস (জওঞঊঝ- জধরষ ওহফরধ ঞবপযহরপধষ ধহফ ঊপড়হড়সরপ ঝবৎারপবং) এবং বাংলাদেশের আইআইএফসি’র (ওওঋঈ) গঠন ও কার্যাবলি পর্যালোচনা করে রেলের জন্য যুগোপযোগী একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মূলত রেলের উন্নয়ন কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও নিজস্ব প্রযুক্তি দিয়ে পোড়া লোকমোটিভ ও ডেমু পুনর্বাসন, দেশেই রেল ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ তৈরির উদ্যোগও তার হাত দিয়েই নেওয়া। তিনি বলেন, নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে, বাধাও রয়েছে। সবকিছু অতিক্রম করেই এসব কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। ভবিষ্যতে এমন আরও নতুন নতুন বিষয় যুক্ত করে রেলকে আধুনিক করার চিন্তা রয়েছে।
সাক্ষাতকারের শেষ পর্যায়ে তিনি বলেন, এভাবেই কর্মস্থলে নানামুখী অবদান রাখার পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্যচর্চার মাধ্যমেই নিজেকে নিয়োজিত রাখতে চাই সবার মাঝে। কিন্তু জীবন অনেক ছোট। এই ছোট্ট জীবনেও সাধ্যমতো অবদান রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আগামীর সফলতায় তিনি সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।

 

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, সিলেট কেন্দ্রীয় লেখক ফোরাম।

প্লিজ আপনি ও অপরকে নিউজটি শেয়ার করার জন্য অনুরোধ করছি

এ জাতীয় আরো খবর..